রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট সিলেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। রাতারগুলের এই জলাবন বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং এই বনে ব্যাপক উদ্ভিদবৈচিত্র্য এবং প্রাণী বৈচিত্র্য থাকায় বাংলাদেশ সরকার একে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। আজকের গল্পের বিষয় অত্যন্ত সুন্দর দেখার মত এই প্রাকৃতিক জলাবন। 

 

রাতারগুল-সোয়াম্প-ফরেস্ট
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

জলাবন আসলে কি

জলাবন মূলত এমন সব অরণ্য বা  বন যা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় বা পুরোটা সময় জুড়ে পানির নিচে থাকে।  জলাবনগুলো মিঠাপানির জলাবন হতেও পারে, আবার লোনা পানির জলাবনও হতে পারে। মিঠাপানির জলাবন গুলো সাধারণত নদ-নদী বা হ্রদের পার্শ্ববর্তী নিম্নাঞ্চলে হয়ে থাকে। ব্রাজিলের আমাজন নদীর অববাহিকায় একটি সুপরিচিত জলাবন রয়েছে  যা ভার্জিনিয়া নামে পরিচিত। পৃথিবীতে মিঠাপানির জলাবন এর সংখ্যা খুব বেশি নেই, তারমধ্যে রাতারগুলের জলাবন বাংলাদেশের একমাত্র এবং পৃথিবীর অল্প কিছু সংখ্যক জলাবনের মধ্যে অন্যতম । 

 

সিলেটের রাতারগুল জলাবন 

সিলেটের গোয়াইন নদীর পাশেই গোয়ানঘাট নামক অঞ্চলে রাতারগুল জলাবন অবস্থিত। এই বনটি শুধু বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলবনই নয়, এটি অন্যতম জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে সরকার কর্তৃক ঘোষিত। ২০১৫ সালের ৩১ মে থেকে এই বনটি বাংলাদেশের বন বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে।

 

এই বনের  বৈশিষ্ট্য 

এই বোন মূলত চির সবুজ বন।  বনটি গোয়াইন নদী এবং চেঙ্গির খাল এর সাথে সংযুক্ত। এই বোনটির একটি বড় অংশ সাধারণত পুরো বছর জুড়ে পানির নিচে থাকে,  সেজন্যই একে জলাবন বলা হয়। বর্ষাকালে এখানে সাধারণত সর্বোচ্চ ৩০ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে থাকে গাছগুলো,  বাকি সময় ১০ ফুট পর্যন্ত পানি থাকে এখানে । করচ গাছই এ বনের প্রধান বৃক্ষ।  

রাতারগুল-সোয়াম্প-ফরেস্ট-সিলেট
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট সিলেট

 

এখানকার উদ্ভিদবৈচিত্র্য 

এই বনটি প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠেছে। পরবর্তীতে এখানে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে জলি টিকে থাকতে পারে এমন কিছু গাছ সংযোজন করা হয়েছে। এই বনে প্রধানত করচ হিজল, পিঠালি,  বরুণ, অর্জুন, গুটিজাম, ছাতিম এবং বট গাছ রয়েছে। পরবর্তীতে লাগানো গাছের মধ্যে রয়েছে মুর্তা, কদম, হিজল, বেত ইত্যাদি। এবনে ৭৩ প্রজাতিরও বেশি উদ্ভিদ রয়েছে। মোটিভেশন এবং এখানে প্রচুর উদ্ভিদ রয়েছে। 

রাতারগুল-বনের-গাছ-শুকনো-স্থানে
রাতারগুল বনের গাছ শুকনো স্থানে

 

এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য

এখানে সব সময় পানি থাকে বলে এখানে প্রচুর সাপ দেখতে পাওয়া যায়, রয়েছে গুইসাপও। এছাড়াও সাপের শত্রু বেজিও এখানে রয়েছে। এখানকার গাছে  এবং পানিতে রয়েছে প্রচুর জোক। এখানকার গাছে বানর রয়েছে। রাতারগুল জলাবন প্রচুর পাখি দেখতে পাওয়া যায়। রয়েছে মাছরাঙ্গা, বক, পানকৌড়ি, ঘুঘু,  টিয়া, বুলবুলি, ঢুপি,  চিল, বাজপাখি এবং শকুন। শীতকালে অতিথি পাখিরও আগমন ঘটে এখানে।

 

এখানকার আবহাওয়া 

এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং খুবি আর্দ্র জলবায়ু বিরাজ করে। সাধারণত শীতকালে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১/১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪/৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে।  

 

এ বনের নাম রাতারগুল হওয়ার কারণ 

মূলত সিলেটি ভাষায় মুর্তা গাছকে রাতা গাছ বলা হয়। সেজন্যই এ কে মুর্তার বন, মানে রাতারগুল হিসেবে ডাকা হতো। সেখান থেকেই এই বনের নাম রাতারগুল হয়েছে । জলাবন হওয়ায় একে ইংরেজিতে সোয়াম্প ফরেস্ট  বলা হয়।

 

রাতারগুল-জলাবন-ওয়াচ-টাওয়ার-থেকে
রাতারগুল জলাবন ওয়াচ টাওয়ার থেকে

 

এই বনে পর্যটকদের দেখার মত কি রয়েছে 

পর্যটকরা সাধারণত এই চির সবুজ বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যই রাতারগুলে আসেন। এখানকার অধিকাংশ অঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত থাকায় নৌকা চলাচলের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নৌকায় করে পর্যটকরা বনের ভিতর ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পায় যেটা এখানকার পর্যটকদের জন্য অন্যতম উপভোগ্য বিষয়। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার থেকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দেখা যায়। মূলত জলাবন কেমন হয় এবং এখানকার উদ্ভিদবৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যেই পর্যটকরা এখানে ভিড় করে।

 

রাতারগুল কিভাবে যাব

রাতারগুল যেতে হলে প্রথমে আপনাকে সিলেট শহরে আসতে হবে। সিলেট থেকে রাতারগুল যাওয়ার কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা রয়েছে। প্রত্যেকটি রাস্তায়ই মূলত একাংশ স্থলপথে এবং বাকি অংশ নৌকাযোগে যেতে হয়। তুমি যে রাস্তা দিয়ে যায় না কেন আপনাকে বেশ পয়সা খরচ করতে হবে।  

একটা সহজ রাস্তা হচ্ছে সিলেট শহর থেকে সারিঘাট যাওয়া, তারপর সারিঘাট থেকে সিএনজি যোগে গোয়ানঘাট বাজারে আসা এবং গোয়ানঘাট বাজার থেকে নৌকাযোগে রাতারগুলে পৌঁছানো। 

আরেকটা রাস্তা হচ্ছে,  সিলেটের আম্বরখানা মোড় থেকে শ্রীঙ্গি ব্রিজ আশা তারপর শ্রীঙ্গি ব্রিজ থেকে নৌকা যোগে রাতারগুল পৌঁছানো।

আরো একটি প্রচলিত রাস্তা হচ্ছে,  সিলেটের আম্বরখানা মোড় থেকে সিএনজি করে সাহেব বাজার হয়ে মোটরঘাটে পৌঁছানো তারপর মোটরঘাট থেকে নৌকা যোগে রাতারগুল বনে পৌঁছানো যায়। 

আপনাকে ভ্রমণ করার সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যদি আপনারা সংখ্যায় চার পাঁচজন হন আর একটা গ্রুপ করে যান তাহলে আপনাদের খরচ কম পড়ব, জনপ্রতি খরচ ভাগ হয়ে যাবে। কিন্তু সিঙ্গেল বা দুইজন গেলে খরচটা আপনাদের একটু বেশি পড়বে। এখানে সিএনজির ভাড়া এবং নৌকার ভাড়া নির্ধারিত না, বেশ দামাদামি করতে হয়।  ভ্রমণের পূর্বে তৎকালীন কত রেট চলছে, এটা স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে ভালো করে জেনে বুঝে তারপর দামাদামি করে নৌকা এবং সিএনজি ভাড়া করতে হবে।

 

আমার রাতারগুল ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা 

আমার রাতারগুল যাওয়ার একবারই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার কাছে রাতারগুল একটি চমৎকার ভ্রমণ গন্তব্য মনে  হয়েছে। এখানকার বনের গাছপালা সত্যিই একটু ভিন্ন ধরনের এবং পানির উপর নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতিই আলাদা। আমার রাতারগুলে ভ্রমণের সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লেগেছিল সেটা হচ্ছে এখানকার মাঝিরা সবাই মোটামুটি গান জানে। নৌকায় করে যখন বনের ভিতরে প্রবেশ করা হয় তখন এখানে অন্যরকম এক পরিবেশ বিরাজ করে, সেই মুহূর্তে আপনার মাঝি যদি গান জানে তাহলে সে গান গাইতে শুরু করবে এবং তার সাথে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য মাঝিরাও তাল দিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করবে। বোনের এই পরিবেশে মাঝিদের এই গান আপনাকে কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এবং আপনি অন্যরকম এক অনুভুতির সাক্ষী হবেন। তবে সব মাঝি কিন্তু গান জানে না,  তাই একটু খেয়াল করবেন যদি আপনার মাঝি গান গাইতে জানে তাহলে সেই নৌকায় কিছু টাকা বেশি ভাড়া লাগলেও আপনার ওই নৌকা তেই উঠা উচিত, সেক্ষেত্রে আপনার ভ্রমণের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে। আর আমার কাছে একটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে বনের ভিতরে যে ওয়াচ টাওয়ার আছে সেখান থেকে পুরো বনটা দেখা যায়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে পানির উপর ভাসমান নৌকা গুলি দেখতে বেশ অসাধারণ লাগে। তবে আপনি যদি বর্ষাকালে রাতারগুল ভ্রমণ করেন তবে সেক্ষেত্রে, গাছে কিন্তু সাপ এবং জোক এর পরিমাণ বেশি থাকে তাই আপনাদের নৌকা যখন গাছের ভিতর দিয়ে যাবে তখন আপনাকে সেক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকতে হবে।  আমার কাছে যে জিনিসটা খারাপ লেগেছিল সেটা হচ্ছে সিলেট থেকে রাতারগুল যাওয়ার যে রাস্তাগুলোর রয়েছে, রাস্তা গুলোর কোনটার অবস্থাই খুব একটা ভালো না। রাস্তাগুলোতে চলাচল করতে বেশ ঝাকি লাগে এবং  উঁচু-নিচু রাস্তা হওয়ায় সময় টাও বেশি লাগে। আর সি এন জি এবং নৌকা দুইটারই ভাড়ার ক্ষেত্রে বেশ দামাদামি করতে হয়। ওরা অনেক বেশি দাম চায় এবং একটা সিন্ডিকেটের মত কাজ করে, তাই সঠিক ভাড়া জেনে না গেলে ঠকার সম্ভাবনা থাকে।

রাতারগুল-বনের-ভিতরে-নৌকা
রাতারগুল বনের ভিতরে নৌকা

সর্বোপরি বলা যায়, রাতারগুলের এই চিরসবুজ জলাবন আপনার বেশ ভালো লাগবে যদি আপনি সবুজ প্রকৃতি ভালোবেসে থাকেন এবং ভিন্ন রকমের একটা বনের দৃশ্য উপভোগ করতে চান। তো এই গল্প এখানেই শেষ করছি এবং অন্যান্য গল্প গুলো পড়ার অনুরোধ রেখে বরাবরের মত এখানেই শেষ করা হচ্ছে ।

Write A Comment