পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র । সমুদ্র সৈকত সবারই ভালো লাগার একটি জায়গা , সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি কক্সবাজারে রয়েছে সুদীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ যার এক পাশে পাহাড় এক পাশে সাগর। কক্সবাজারের সবচেয়ে পরিচিত দুইটি বিচ পয়েন্ট হচ্ছে লাবনি বিচ পয়েন্ট এবং সুগন্ধা বিচ পয়েন্ট । এছাড়াও কক্সবাজারের অন্যান্য জনপ্রিয় বিচ পয়েন্ট গুলোর মধ্যে রয়েছে কলাতলী বিচ, হিমছড়ি বিচ এবং ইনানী বিচ। 

কক্সবাজার-সমুদ্র-সৈকত-এর-ঢেউ
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর ঢেউ

 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর বিশেষত্ব 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত শুধু বাংলাদেশেরই নয় সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, যা বাংলাদেশের একটি গর্ব। এ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত সর্বমোট ১২২ কিলোমিটার দীর্ঘ।  কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এই সমুদ্র সৈকত খুবই অগভীর। অগভীর হওয়ায় এখানে সমুদ্র স্নান , সার্ফিং এবং অন্যান্য বিচ গেম গুলো খেলার জন্য খুবই উপযুক্ত। এছাড়া এখানে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ।  এই মেরিন ড্রাইভ এ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অসাধারণ। মেরিন ড্রাইভের এক পাশে সাগর এবং একপাশে পাহাড় পর্যটকদের মুগ্ধ করে। 

 

মেরিন-ড্রাইভ-কক্সবাজার
মেরিন ড্রাইভ – কক্সবাজার

 

কক্সবাজারের ইতিহাস 

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে কক্সবাজারের এরকম নামকরণ হওয়ার পিছনে কারণ কি! কক্সবাজার নাম হওয়ার পূর্বে এই জায়গার নাম ছিল পানোয়া। মুঘল সম্রাট শাহ সুজা আরকান রাজ্য ভ্রমণের সময় এই স্থানে বহুসংখ্যক পালংকি নিয়ে বিশ্রাম নেয়, ফলে এই জায়গাটি পালংকি নামে পরিচিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স পালংকির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান এবং তার নাম অনুসারেই পরবর্তীতে এই জায়গার নাম কক্স সাহেবের বাজার বা কক্সবাজার নামে পরিচিতি পায়।  

 

কক্সবাজার-সমুদ্র-সৈকত-এর-লাবনী-বিচ
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর লাবনী বিচ

কক্সবাজারের জনপ্রিয় বিচ পয়েন্ট সমূহ 

দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হওয়ায় কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি বিচ পয়েন্ট রয়েছে।  সবচেয়ে জনপ্রিয় বিচ পয়েন্ট গুলো হচ্ছে লাবনী বিচ, সুগন্ধা বিচ, কলাতলী বিচ, হিমছড়ি বিচ এবং ইনানি বিচ। 

লাবনী বিচ

লাবনী বিচ কেই কক্সবাজারের প্রধান বিচ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এটি কক্সবাজার শহর থেকে সবচেয়ে কাছে এবং এই বীচকে কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ দোকানপাট গড়ে উঠেছে । লাবনী বিচ এর মার্কেট পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ, কারণ এখানে মায়ানমার , চীন এবং থাইল্যান্ড থেকে আগত বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। এই মার্কেট বার্মিজ মার্কেট নামেই পরিচিত।  

সুগন্ধা বিচ 

লাবনী বিচের ঠিক পাশেই সুগন্ধা বিচ। লাবনী বিচ থেকে সৈকত বরাবর একটু আগালেই সুগন্ধা বিচ। সুগন্ধা বিচে লাবনী বিচ এর তুলনায় ভীড় হাল্কা একটু কম থাকে।  

কলাতলী বিচ 

কলাতলী বিচ কক্সবাজার এর অন্যতম প্রধান বিচ। ডলফিন মোড় থেকে খুব কাছে এই বিচ পয়েন্ট। সায়মান বিচ রিসোর্ট এর ঠিক সামনের বিচ পয়েন্টই হচ্ছে কলাতলী বিচ। 

হিমছড়ি বিচ 

হিমছড়ি সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, কারণ এখানে একই সাথে সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি হিমছড়ি পাহাড় রয়েছে এবং পাহাড়ে ঝর্ণাও রয়েছে যা দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। কক্সবাজারের মূল সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরেই হিমছড়ি বিচ পয়েন্ট। হিমছড়িতে পাহাড় আছে , পাহাড়ে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে এবং পাহাড়ের উপরে রিসোর্ট রয়েছে। পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র সৈকত দেখতে অসাধারণ সুন্দর লাগে যা নিজ চোখে না দেখলে কল্পনা করা কঠিন। এখানে পাহাড়ের ঢালে ঝর্ণাও আছে।

ইনানি বিচ

আমার মতে, ইনানী বিচ কক্সবাজার এর সবচেয়ে সুন্দর বিচ পয়েন্ট। ইনানি বিচ কক্সবাজারের মূল সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ইনানী নামক স্থানে অবস্থিত। দূরত্বের কারণে অনেক পর্যটকই ইনানী বিচ ঘুরতে আসে না। তবে হ্যাঁ ইনানি বিচ অন্য সব বিচ এর থেকে একদম আলাদা এবং এর সৌন্দর্য অন্যসব বিচের চেয়ে আমার কাছে একটু বেশিই মনে হয়েছে। ইনানী বিচের পানি খুব পরিষ্কার এবং এখানকার বিচের বালু ও খুব সুন্দর, বেশ ভালো চিকচিক করে। এখানে পর্যটকদের সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ায় বিচটি বেশ উপভোগ করা যায়। 

 

কক্সবাজার-সমুদ্র-সৈকত-এ-সূর্যাস্ত
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এ সূর্যাস্ত

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা 

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সূর্যোদয়ের সময় সমুদ্র সৈকতে ভীড় একটু কম থাকলেও সূর্যাস্ত দেখতে প্রচুর মানুষ ভীড় করে। বিশাল সাগরের বুকে সূর্যকে তলিয়ে যেতে দেখার যে কি আনন্দ তা আপনি নিজ চোখে দেখলেই কেবল অনুভব করতে পারবেন। সূর্যাস্তের এই দৃশ্য আপনাকে কল্পনার এক অদ্ভুত জগতে নিয়ে যাবে। আপনি আসলে এখানে বসে অনুভব করতে পারেন পৃথিবী এবং সৃষ্টিতত্ত্বের নানান দিক।  সমুদ্রের বুকে কমলা আভা ছড়াতে ছড়াতে সূর্য যখন অস্ত যাবে তখন অনেকেই ছবি তুলতে খুবই উৎসাহ বোধ করেন। অনেকে তো আবার হাতের মুঠোয় অথবা আংগুলের উপর সূর্য রেখে ছবি ছবি তুলে বিশেষ আনন্দ অনুভব করে। মনে হয় যেন সূর্যটা তার হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে । সমুদ্রের তীরে সারি সারি বেঞ্চ বসানো থাকে যাতে দর্শনার্থীরা শান্তিতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে পারে। ঘণ্টাপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা খরচে ভাড়া নিতে হয় এই বেঞ্চগুলো।  সাধারণতঃ সূর্যাস্তের ২ ঘণ্টা আগে বেঞ্চগুলো ভাড়া নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ পরবর্তীতে অসংখ্য মানুষ সূর্যাস্ত দেখার জন্য ভিড় করে, যার ফলে বেঞ্চের সংকট দেখা দেয়। 

 

কক্সবাজার-সমুদ্র-সৈকতে-বিচ-এক্টিভিটি
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিচ এক্টিভিটি

সৈকতে কি কি করার আছে 

সৈকত আসলে অনেক কিছুই করার মতো রয়েছে, এগুলো কে বিচ অ্যাক্টিভিটি বলে থাকে বলা হয়ে থাকে। বিচ অ্যাক্টিভিটি গুলোর মধ্যে খুব জনপ্রিয় অ্যাক্টিভিটি হল ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিচ পরিদর্শন, সাগরের জলে গোসল করে মাতামাতি করা, সাগরে স্পিডবোট ভ্রমণ, প্যারাগ্লাইডিংকরে আকাশে ভেসে বেড়ানো, সার্ফিং করা , বিচে ফুটবল খেলা, ছোট ছোট বিস্তারে করে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে রাইড দেওয়া, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা, বিচ ফটোগ্রাফি করা, ব্রীজের ধারে বেঞ্চে বসে বিচার সৌন্দর্য উপভোগ করা ইত্যাদি। এছারাও বিচ মার্কেটে শপিং করা, হালকা কিছু খাওয়া, গান গাওয়া সহ আরও নানান রকম অ্যাক্টিভিটি করে আপনি আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। আসলে আপনি বিচে গেলে আপনার মনই বলে দিবে আপনি কি করতে চান। আপনার জন্য করার অনেক কিছুই রয়েছে তবে একেক জনের কাছে একেক টা বিষয় বেশি ভালো লাগে।   

 

কক্সবাজারে আমার অভিজ্ঞতা 

আমার অভিজ্ঞতা বলতে গেলে প্রথম যেবার আমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলাম আমি সমুদ্রের ধারে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বিশাল সমুদ্র দেখে। আমার মনের ভেতর কি যেন এক অজানা আনন্দময় অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, আমি এই সৃষ্টি জগত সম্পর্কে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে সমুদ্র সৈকত দেখছিলাম আর ভাবছিলাম সমুদ্র সৈকত এর চেয়ে আর কোন পর্যটন স্পট বেশি আনন্দময় হতে পারে! আমি মোট তিনবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গিয়েছি। যতবার যায় ততোবারই ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা হয়। এখানে উপভোগ করার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। নানান রকম বিচ একটিভিটি তো রয়েছেই, এছাড়াও মেরিন ড্রাইভ এ চাঁদের গাড়ীতে করে ঘোরার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। মেরিন ড্রাইভে ভ্রমণ করতে করতে এক পাশে সাগর এবং একপাশে পাহাড় দেখা এবং সাগর থেকে আসা সুশীতল বাতাস আপনার গা যখন ছুঁয়ে যাবে, সেই অনুভূতি যেকোনো অনুভূতির আনন্দকে ছাপিয়ে যেতে বাধ্য।  আর আমার কাছে লাবনী বিচ ও সুগন্ধা বিচ এর চেয়ে হিমছড়ি বিচ এবং ইনানী বিচ বেশি সুন্দর লেগেছে। হিমছড়ির পাহাড় আপনাকে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা দিবে। পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র সৈকত দেখার যে অভিজ্ঞতা তা আসলে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার ক্ষেত্রে। আর ইনানী বিচের সৌন্দর্য সে তো এক অন্যরকম সৌন্দর্য ইনানী বিচ আসলে বাকি সব বিচের চেয়ে একটু বেশিই সৌন্দর্যমন্ডিত।  

 

কক্সবাজার-সমুদ্র-সৈকত-এর-দৃশ্য
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর দৃশ্য
কক্সবাজার-সমুদ্র-সৈকত-এর-উপর-দিয়ে-বিমান-উড়ে-যাওয়ার-দৃশ্য
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর উপর দিয়ে বিমান উড়ে যাওয়ার দৃশ্য

 

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান এর তালিকায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে প্রথমেই রাখতে হবে, কারণ সমুদ্র বেশিরভাগ পর্যটকদেরই পছন্দের, আর বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত বলতে তো একমাত্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতই আছে। এই ছিল দীর্ঘতম কক্সবাজার এর সৈকত এর গল্প, অন্যান্য গল্পগুলো পড়ার অনুরোধ জানিয়ে এখানেই শেষ করতে হচ্ছে।  

Write A Comment