যারা সাগর পছন্দ করেন, বিশেষ করে দ্বীপ ভ্রমণ এর প্রতি যাদের আকর্ষণ রয়েছে তাদের জন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ হতে পারে একটি অসাধারণ ভ্রমন’ গন্তব্য। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপ এবং এ দীপ আপনাকে এক মনমুগ্ধকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম । তাহলে এবার আপনাদের এই সেন্টমার্টিন দ্বীপের গল্পই শোনানো যাক।

 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ

সেন্টমার্টিন মূলত একটি প্রবাল দ্বীপ যা বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। আয়তনের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সেন্টমাটিন অত্যন্ত ছোট। মাত্র ৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ ক্ষুদ্র দ্বীপটি মূলত নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। 

 

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ইতিহাস 

ইতোপূর্বে সেন্টমার্টিন দ্বীপ জিনজিরা নামেই পরিচিত ছিল।  অতীতে আরব বণিকরা তাদের ব্যবসায়িক সফরের যাত্রাপথে এই জিনজিরা দ্বীপে বিশ্রাম নিত এবং এখানে তারা প্রচুর নারিকেল গাছ রোপন করেছিল যার ফলশ্রুতিতে এই দ্বীপের নাম নারিকেল-জিন্জিরা হিসেবে পরিচিতি পায়। এ দ্বীপে মূলত কিছু বাঙালি এবং কিছু রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতো তাদের অধিকাংশই ছিল মৎস্যজীবী। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশদের দ্বারা ভূমি জরিপের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনকে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯০০ সালের দিকে এই দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ রাখা হয়। কারো কারো মতে এই দ্বীপের নাম সেন্টমার্টিন রাখা হয়েছে একজন খ্রিষ্টান সাধু সেন্টমার্টিন এর নাম অনুসারে, আবার কারো কারো মতে এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছিল তৎকালীন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের নাম অনুযায়ী যার নাম ছিল মার্টিন। 

 

সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-নারিকেল-গাছ
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর নারিকেল গাছ

 

দ্বীপটির বিশেষত্ব 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ অত্যন্ত সুন্দর একটি কোরাল দ্বীপ। ছোট হলেও এর জীববৈচিত্র্য অনেক সমৃদ্ধ। মূলত অগভীর নীল জলরাশি এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ। এখানকার জলরাশি খুবই স্বচ্ছ এবং কিছুটা নীলাভ বর্ণের মনে হয় এবং উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সব পরিষ্কার দেখা যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বিচ থেকে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে থাকলেও কোমর এর উপরে পানি উঠে না, তবে কোরাল দ্বীপ হাওয়ায় এখানে রিপ কারেন্ট থাকে, সেইজন্য বেশি দূর পানিতে নামায় নিরাপদ।  

 

এই দ্বীপে মূলত কারা ঘুরতে যায়

এই দ্বীপে মূলত বাংলাদেশী নাগরিকরাই বেশি ঘুরতে আসে। তবে অল্প সংখ্যক বিদেশী নাগরিকদের কেউ এখানে ঘুরতে আসতে দেখা যায়। বাংলাদেশের ভ্রমণ প্রেমী মানুষের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ টি খুব জনপ্রিয় এবং বহু পর্যটক রয়েছে যারা প্রতি বছরে একবার সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘুরতে আসে।  এখানকার পর্যটন ব্যবস্থা উন্নত করা গেলে এবং প্রচার-প্রচারণা চালানো গেলে বহু সংখ্যক বিদেশি পর্যটকরাও দ্বীপ টি ভ্রমণে আগ্রহী হবে বলে আশা রাখা যায়।

 

সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-স্পীড-বোর্ড
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর স্পীড বোর্ড

 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে কেমন খরচ হতে পারে

ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা খরচ আছে বাসের ভাড়া এবং অন্যটি জাহাজের ভাড়া। প্রথমে ঢাকা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যেতে হয় বাসে করে, তারপর টেকনাফ থেকে জাহাজে করে যেতে হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। ঢাকা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নন এসি বাসের টিকিটের খরচ পড়বে সর্বনিম্ন ৯০০ টাকা টাকা। আর কেয়ারী সিন্দাবাদ জাহাজে করে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে খরচ পড়বে সর্বনিম্ন ৬৫০ টাকা, জাহাজের এই টিকিটে ফিরতি টিকিট এর খরচও অন্তর্ভুক্ত থাকে।  তার মানে আপনাকে ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য সর্বনিম্ন খরচ করতে হবে ২৪৫০ টাকা (বাসের টিকিট ৯০০ টাকা + ৯০০ টাকা এবং জাহাজে ফিরতি টিকিটসহ ৬৫০ টাকা) । এরপর আপনি যদি সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়ে সেখানে এক রাত থাকতে চান তাহলে আপনাকে রিসোর্ট ভাড়া করতে হবে রিসোর্টের ভাড়া সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা পড়বে একজনের জন্য । কাপল গেলে সর্বনিম্ন ১০০০ টাকার রুম ভাড়া করতে হবে। যাতায়াত খরচ সবসময়ই একই থাকলেও হোটেল রুমের ভাড়া কিন্তু সিজন অনুযায়ী ওঠানামা করে। তার মানে যখন সেন্টমার্টিন ভ্রমনের সবচেয়ে পিক টাইম চলে তখন কিন্তু রুমের ভাড়া বাড়তি দিতে হয়। এখানে সবকিছুতে সর্বনিম্ন খরচ তাই উল্লেখ করা হয়েছে আপনি যদি আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা চান তাহলে আপনাকে বাড়তি টাকা তো খরচ করায় লাগবে। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপে খাওয়া দাওয়ার জন্য এবং ওখানে গিয়ে চলাচলের জন্য সাইকেল ভাড়া অথবা ভ্যান ভাড়া সাথে রাখতে হবে।  

 

সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-রিসোর্ট
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর রিসোর্ট

 

এখানে ঘুরতে যাওয়ার আগে যে যে বিষয় গুলো জানা দরকার

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের ক্ষেত্রে আপনি যদি ঢাকা থেকে রওনা দেন তাহলে রাতের গাড়িতে রওনা দেওয়ায় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে।  কারণ রাতের বাস সাধারণত সকাল ৭ টার মধ্যেই টেকনাফ এর দমদমিয়া জাহাজ ঘাটে পৌঁছে যায়। জাহাজ ঘাটে আপনি সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে জাহাজের টিকিট চেক করিয়ে সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে জাহাজে উঠে পড়তে পারেন এবং জাহাজ দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যেই সেন্টমার্টিন পৌঁছে যায় । আর আপনি যদি ওই দিনই সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ হইতে চান তাহলে আপনাকে দুপুর তিনটার মধ্যে জাহাজে উঠে পড়তে হবে , কারণ দুপুর তিনটার সময় ওই জাহাজটি সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়ে দেয় টেকনাফের উদ্দেশ্যে । সে ক্ষেত্রে আপনি মাত্র ২ ঘন্টা সময় পাবেন সেন্টমার্টিন দ্বীপ টি দেখার জন্য যা আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয় না।  সেন্টমার্টিন দ্বীপ টি সম্পূর্ণ ভালভাবে ঘুরে দেখার জন্য এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এখানে একরাত না থাকলেই নয়। আর এ দীপের রাতের সৌন্দর্য সেতো অবর্ণনীয়। রাতে সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে সাগরের পাড়ে বেঞ্চে শুয়ে আকাশের তারা দেখা সে তো এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সেজন্যই সেন্টমার্টিন দ্বীপে একরাত না থাকলে এই ভ্রমণ পরিপূর্ণ হয় না। এদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ হোটেল রয়েছে তাই খাবার-দাবার নিয়ে চিন্তার কোন কারণই নেই। এদ্বীপে বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটরের মাধ্যমে রাতে বাতি জ্বালানো হয়। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আর নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সাগরে জাহাজ চলে। এছাড়া অন্য কোন সময় সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করতে হলে আপনাকে ট্রলারে করে ভ্রমণ করতে হবে যা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। 

সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-কোরাল-মাছ
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর কোরাল মাছ

 

এই দ্বীপটি পর্যটকদের জন্য কতটুকু নিরাপদ

সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। পুরো দ্বীপটি নৌ বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এখানে কোস্ট গার্ড পাহাড়ায় রয়েছে। এছাড়াও এই দ্বীপে কমিউনিটি পুলিশ রয়েছে।  তাছাড়া এই দ্বীপের মানুষ খুবই ধার্মিক এবং তারা পর্যটকদের সাথে খুব ভালো আচরণ করে।  এই দ্বীপটি অত্যন্ত ছোট এবং চারপাশ সাগরে ঘেরা তাই এখানে কোন প্রকার চুরি-ডাকাতি বা এ জাতীয় কোন ঘটনা কখনোই হয় না এবং হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে । সেজন্য আপনাকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, আপনি নিশ্চিন্তে গ্রহণ করতে পারেন।

 

আমার অভিজ্ঞতা 

আমার এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে তিনবার সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যতবারই সেন্টমার্টিন দ্বীপে যায় ততোবারই দ্বীপটিকে নতুন করে অনুভব করার চেষ্টা করি, এ দ্বীপের সৌন্দর্য কখনোই আমাকে হতাশ করেনি। প্রথমবার যখন সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম তখন তো এখানকার স্বচ্ছ নীল জলের পানিতে পা ভিজিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল এর চেয়ে সুন্দর জায়গা পৃথিবীতে আর বোধহয় একটিও নেই । আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র বলতে গেলে এই সেন্টমার্টিন দ্বীপই। এখানকার বিশুদ্ধ শীতল বাতাস আপনার প্রাণ জুড়িয়ে যাবেই। সাধারণত শীতকালে সেন্টমার্টিন ভ্রমনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়, অন্যান্য সময় এখানে জাহাজ চলে না তাই পর্যটকদের ভিড়ও দেখা যায় না। এখানে ছেড়া দ্বীপ নামে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রয়েছে এই দ্বীপটি অত্যন্ত সুন্দর। ভাটার সময় পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে করে ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়া যায়। এছাড়াও নৌকায় করে এবং স্পীড বোটে করে ছেড়াদ্বীপ যাওয়া যায় । সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রচুর নারিকেল গাছ এবং কেয়া গাছ দেখতে পাওয়া যায়।  এখানে খাওয়ার জন্য ডাবের পানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে কারণ বিচে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেই পানি পিপাসা লেগে যায়। আমার কাছে এখানকার রাতের পরিবেশটা খুবই অসাধারণ লেগেছে রাতে সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে অন্য রকম ভালো লাগে। আর বিচে বসে আকাশের তারা দেখা সে তো এক চমৎকার ব্যাপার। সকালের সূর্যোদয় দেখা এবং বিকালে সূর্যাস্ত দেখা আমাকে প্রতিবারই মুগ্ধ করেছে। আর সাগরের জলে গোসল করা সে তো সব সময়ই আনন্দের।

 

সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এ-সূর্যদয়
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এ সূর্যদয়
সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-বিচ-ফুটবল
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর বিচ ফুটবল
সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-রাতের-সোন্দর্য
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর রাতের সোন্দর্য
সেন্টমার্টিন-দ্বীপ-এর-ঝিনুক
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর ঝিনুক
নাফ-নদীর-গাঙচিল
নাফ নদীর গাঙচিল

পরিশেষে বলতে হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৌন্দর্য বাংলাদেশের যেকোনো পর্যটন স্পট এর সৌন্দর্য কে ছাপিয়ে যায়। আপনি যদি এখন পর্যন্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ না করে থাকেন তাহলে আপনার জন্য দ্বীপটি শীঘ্রই ভ্রমণের সাজেশন রেখে আজকের গল্প এখানেই শেষ করছি। 

Write A Comment