পার্কি বিচ চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি অসাধারণ সুন্দর সমুদ্র সৈকত যা হতে পারে একটি আকর্ষণীয় ভ্রমণ কেন্দ্র। তবে অনেকেই আছেন যারা হয়তো এখন পর্যন্ত এ পারকি সৈকত এর নামই শোনেননি। সৌন্দর্যের দিক থেকে অতুলনীয় হলেও ভ্রমণ জটিলতার কারণে অথবা প্রচার প্রচারণার অভাবে এই সমুদ্র সৈকত এখন পর্যন্ত তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত বলতে অধিকাংশ মানুষ চিনে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, এছাড়াও চট্টগ্রামের গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকত ও মোটামুটি পরিচিত। তবে চট্টগ্রামে যে এত সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকত পার্কি বিচ রয়েছে তা হয়তো অনেক ভ্রমণ প্রেমী মানুষেরই অজানা। আজকে আমাদের গল্পের বিষয় অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন স্পর্ট এই পার্কি বিচ সম্পর্কে।
পার্কি বিচ এর অবস্থান
বঙ্গোপসাগরে যেখানে কর্ণফুলী নদী মিলিত হয়েছে সেখানেই এই পার্কি বিচ অবস্থিত। পার্কি বিচ এর অবস্থান আনোয়ারা উপজেলায় চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। এই পারকি সৈকত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, অনেকে কে পারকির চর হিসেবেও উল্লেখ করে থাকে।
পারকি সৈকত এর বিশেষত্ব
পারকির চরের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানকার সৈকতে আটকে থাকা বিশাল বড় এক জাহাজ এবং এখানকার অনাবিল সুন্দর সূর্যাস্তের দৃশ্য। একইসাথে কর্ণফুলী নদীর মোহনা দেখা যায় এখানে আসলে। অধিকাংশ পর্যটক এখানে আটকে থাকা এই প্রকাণ্ড জাহাজটি দেখতে আসে। কেউবা আসে কর্ণফুলীর নদীর মোহনা দেখতে আবার অনেকেই আসে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে। এই বিচে পর্যটকের ভির কিছুটা কম থাকায় এখানকার সৌন্দর্যটা গভীরভাবে অনুভব করা যায়। তাছাড়া এখানে ঘোড়ার পিঠে করে সৈকত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও আপনি অনায়াসে অর্জন করতে পারবেন। এছাড়া মোটরসাইকেল এবং স্পিডবোট ভ্রমণের সুযোগ তো রয়েছেই।
পার্কি বিচ কিভাবে যাবেন
চট্টগ্রাম শহর থেকে পার্কি বিচ যাওয়ার কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা রয়েছে। মূলত বিমানবন্দর এলাকা অথবা বোট ক্লাব হতে কর্ণফুলী নদী পার হলেই খুব সহজে অটোরিকশায় করে পারকির চরে যাওয়া যায়। পারকির চর এর অবস্থান মূলত আনোয়ারা উপজেলায়, এই সৈকত বারাসাত ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। প্রথমে আপনাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে বাসে করে আসতে হবে বোট ক্লাবে, তারপর তারপর কর্ণফুলী নদীর জেটিঘাট থেকে নৌকায় করে কর্ণফুলী নদী পার হতে হবে। কর্ণফুলী নদীর ওপারে আনোয়ারা উপজেলা। আনোয়ারায় এসে আপনাকে অটো রিক্সা অথবা সিএনজি ভাড়া করে পৌঁছাতে হবে পার্কি বিচে। আমার কাছে ওই রাস্তাটায় সবচেয়ে সহজ মনে হয়। এছাড়া আরেকটি জনপ্রিয় রাস্তা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহর থেকে বাসে করে আনোয়ারা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানো তারপর সেখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সা করে পারকির চরে চলে আসা। বলতো প্রথমে আনোয়ারায় আসতে হবে তারপর আনোয়ারা থেকেই এই সৈকতে পৌঁছাতে হয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে যেই পথেই আপনি পারকি সমুদ্র সৈকতে আসেন না কেন, আপনার প্রায়ই দেড় ঘন্টা সময় লাগবে।
আনোয়ারা থেকে পারকির চরে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
আনোয়ারা থেকে অটোরিকশা যোগে পারকির চরে পৌঁছাতে আধাঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিটের মত সময় লাগে। একা আসলে অটোরিকশায় খরচ একটু বেশি পড়ে, তবে ৩/৪ জন বন্ধু মিলে আসলে অটোরিকশায় বেশ পরতা হয়। আর অটোরিকশায় চেপে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পারকির চর যেতে হয়, এখানকার দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সত্যি কথা বলতে বন্ধুরা মিলে সবাই এখানে গান জুড়ে দেয়, এই সুন্দর রাস্তায় শীতল বাতাস গায়ে লাগাতে লাগাতে গানের তালে তালে গ্রামের প্রকৃতির দৃশ্য দেখার সেকি অনাবিল আনন্দ তা এখানে ভ্রমণের পূর্বে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সত্যি বলতে আনোয়ারার এই রাস্তায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পারকি বিচ এর আনন্দ কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
পারকি সৈকতের সূর্যাস্ত
পারকির সমুদ্র সৈকতের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এখানকার বিকেলের সূর্যাস্তের সময়। অধিকাংশ পর্যটকই এখানে সাধারণত বিকেলেই ঘুরতে আসে। বিকেলে আসার কয়েকটা সুবিধা রয়েছে তার মধ্যে একটি বড় সুবিধা হচ্ছে বিকেলে সূর্যের তাপ কম থাকে তাই পরিবেশটা বেশি শীতল থাকে এবং একই সাথে সূর্যাস্ত ও দেখা যায়। পারকি সৈকত এর বিস্তীর্ণ জলরাশি বুকে যখন রক্তিম কমলা বর্ণের সূর্যটা ঢলে পড়ে সেই দৃশ্য আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে কল্পনার জগতে। এখানকার সূর্যাস্ত টা একটু বিশেষ রকমেরই সুন্দর আসলে প্রত্যেকটা সৈকতের ভিন্ন ভিন্ন বিশেষত্ব থাকে। আমার মতে এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে এখানকার সূর্যাস্ত। ফটোগ্রাফারদের জন্য তো এ দৃশ্য এক বহু প্রতীক্ষিত বিষয়বস্তু।
আটকে পড়া জাহাজের এর ইতিহাস
এখানে যে জাহাজটি আটকে আছে তার নাম ক্রিস্টাল গোল্ড। এটি মূলত একটি মালবাহী জাহাজ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ২০১৭ সালের ৩০ মে, যে ঘূর্ণিঝড় মোরা আঘাত হেনেছিল বঙ্গোপসাগরে, সেই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাহাজটি নোঙ্গর ছিড়ে পারকি সৈকতে আটকে যায়। পরবর্তীতে নানা জটিলতার কারণে জাহাজটিকে এখান থেকে আর সরানো হয়নি। দীর্ঘদিন সৈকতে পড়ে থাকায় জাহাজটি অকেজো হয়ে যায়, এখন বোধ হয় আর ব্যবহারের উপযোগী নাই জাহাজটি। পরিবেশবাদীরা বলছেন এই জাহাজটি বিচের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ তাই দ্রুতই এই জাহাজটিকে এখান থেকে অপসারণ করা উচিত। তবে যাই হোক জাহাজটি কিন্তু বিচের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে আমার মতে। অনেকে তো শুধু এই জাহাজটি দেখার জন্যই দূর-দূরান্ত হতে এই সৈকতে আসেন। সত্যি বলতে গেলে এই জাহাজটির কারণেই এই বিচার পরিচিতি এত বেশি বেড়েছে।
পার্কি বিচ এ কি কি করার আছে
পারকি বিচ এ করার মত অনেক কিছুই রয়েছে । এখানে মোটরসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়, অনেকে মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে চালাতে দেখা যায়। এখানকার অন্যতম একটি প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এখানে স্পিড বোর্ড আছে স্পিডবোটে করে সমুদ্র ভ্রমণ করা যায় যেটা অনেকের কাছেই খুব পছন্দনীয় একটা ব্যাপার। তাছাড়া এখানে ঘোড়া রয়েছে ঘোড়ার পিঠে করেও সমুদ্র সৈকত ভ্রমন করা যায়। এবিসি কিছু দোকানপাটও রয়েছে এখান থেকে হালকা খাবার, আচার, নানা রকমের বার্মিজ এবং থাইল্যান্ডের জিনিস পাওয়া যায়, যা অনেকেই পছন্দ করে থাকে। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে এখানকার সূর্যাস্ত দেখা। আর যে জিনিসটা পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পারকি বিচ আটকে থাকা ক্রিস্টাল গোল্ড নামের এই বিশাল মালবাহী জাহাজ, যা ঘূর্ণিঝড় মোরার সময় এখানে আটকে পড়েছিল। এছাড়াও যেহেতু এখানে কর্ণফুলী নদী বঙ্গোপসাগরে এসে মিলিত হয়েছে তাই একইসাথে কর্ণফুলী নদীর মোহনা দেখার সুযোগ হয়। সব মিলে পারকি বিচ আমাদের উপভোগ করার মতো অনেক অপশনই দিচ্ছে।
পারকি সৈকতে আমার অভিজ্ঞতা
আমার পারকি বিচ ভ্রমণের অসাধারণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেদিন আমি এই সৈকত ভ্রমন করেছিলাম, সেদিন মূলত আমি এই জায়গাটা সম্পর্কে অবগত ছিলাম না বড় আমি ঘুরতে এসেছিলাম বোট ক্লাবে। পরে এখানে এসে শুনলাম কর্ণফুলী নদী পার হয়ে ওপারে গেলেও অসাধারণ সুন্দর এক সমুদ্র সৈকত রয়েছে যার নাম পারকি বিচ এবং এখানে নাকি এক বিশাল জাহাজ আটকে পড়ে আছে। তাই আমার এই সৈকত দেখার খুব আগ্রহ হলো। অবশেষে নৌকায় করে পাড়ি দিলাম কর্ণফুলী নদী, সেইসাথে কর্ণফুলী নদীর সৌন্দর্য এবং এই নদীতে নৌ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল। নদী পার হয়ে আনোয়ারায় পৌঁছে যখন অটোরিকশা ভাড়া করলাম সৈকতের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য তখন কার অনুভূতিটাও বেশ চমৎকার কারণ এখানকার গ্রামের এত সুন্দর পরিবেশ তা আসলে আমাকে এক কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল। আর পারকি সৈকত আমার দেখা অন্যতম সুন্দর এক সৈকত। প্রচার প্রচারণা চালানো গেলে এটাও হতে পারে অন্যতম আকর্ষণীয় এক পর্যটন কেন্দ্র, তবে সেখানে ভ্রমনের কিছু জটিলতা থেকেই যায়।
তো এই ছিল চট্টগ্রামের পার্কি বিচ এর গল্প। অন্য গল্প গুলো পড়ার অনুরোধ জানিয়ে বরাবরের মত এখানেই শেষ করতে হচ্ছে।