জিন্দা পার্ক বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ছোট্ট একটি আদর্শ গ্রাম এর উদাহরণ যা আমাকে অতিশয় মুগ্ধ করেছিল । বলতে গেলে আমি প্রথম দেখায় জিন্দা পার্কের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। জিন্দা পার্ক ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে অবস্থিত একটি আদর্শ গ্রামের মডেল যা পিকনিক স্পট এবং পার্ক হিসেবে খুবই জনপ্রিয় । আমার এবারের গল্পের বিষয় এই পার্ক যা জিন্দা গ্রামে অবস্থিত ।

জিন্দা-পার্ক-এর-প্রকৃতি
জিন্দা পার্ক এর প্রকৃতি

জিন্দা পার্ক মূলত কি 

জিন্দা পার্ক মূলত আদর্শ গ্রামের উদাহরণ হিসেবে গড়ে তোলা একটি সমাজকল্যাণ মূলক গ্রামীণ সম্প্রদায় । গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য এ গ্রামবাসীর উদ্যোগে  গড়ে তোলা সমাজ কল্যাণ সংগঠনের নিরলস কর্ম প্রচেষ্টার ফসল এই জিন্দা পার্ক । ১৯৮০ সালে এলাকাবাসীর উদ্যোগে “অগ্র-পথিক পল্লী সমিতি’’ নামে যাত্রা শুরু করে সমাজকল্যাণমূলক এই সংগঠনটি । তাদের দীর্ঘদিনের এই প্রচেষ্টার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হিসেবে আজ এই সুন্দর পার্ক টি আমরা পাই । 

 

জিন্দা পার্ক এর বিশেষত্ব 

শুরুতে অল্প জায়গা নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে এটি ১৫০ একর এর মত জায়গা নিয়ে বিস্তৃত । এটা শুধু একটা আদর্শ গ্রামেই নয় এটা একটা ইকোপার্ক এর মত। এখানে যেমন আপনি দেখা পাবেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর, তেমনি বই পড়ার জন্য পেয়ে যাবেন আধুনিক একটি লাইব্রেরী।  আপনি দেখা পাবেন ধর্মীয় উপাসনালয়ের, পেয়ে যাবেন খাবার রেস্টুরেন্ট বা ক্যান্টিন, সেই সাথে দেখা মিলবে ছোট চিড়িয়াখানারও।  তবে আমার মতে জিন্দা পার্কের প্রধান আকর্ষণ এখানকার সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জলাশয় । এখানে দেখা মিলে ২৫০ প্রজাতিরও বেশি গাছ,  যা সংখ্যার হিসেবে দশ হাজারেরও বেশি । এখানে আপনি অনেক দুর্লভ গাছ দেখতে পাবেন । নানান রকমের ফল গাছ, ফুল গাছ , ঔষধি গাছ যেগুলো আপনার জ্ঞান কেই শুধু বিকশিত করবে না, আপনাকে অবাকও করে দেবে । এখানে পাঁচটি জলাশয় রয়েছে যা আসলে পুকুরই বলা যায় । মধ্যভাগের পুকুরটিতে নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে , আপনি নৌকায় বসে ঘুরে ঘুরে এখানে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন । এই পুকুরের একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ড্রাম দিয়ে  তৈরি ভাসমান ব্রিজ । ড্রাম এর এই ভাসমান ব্রিজের উপর দিয়ে  হাঁটতে অন্য রকম একটা অনুভূতি হয় ।  এখানে একটি সুন্দর রেস্টহাউজ রয়েছে, রয়েছে গরুর খামার ,  দেখা পাবেন বেশ কিছু রাজহাঁস এবং হাঁস-মুরগিরও । 

জিন্দা-পার্ক-এর-সোন্দর্য
জিন্দা পার্ক এর সোন্দর্য

জিন্দা পার্কে কারা ঘুরতে যায়

জিন্দা পার্ক পিকনিক করার জন্য একটি আদর্শ জায়গা । এটা আপনি পিকনিক স্পট হিসেবে ভাড়া নিতে পারেন, অথবা এককভাবে পরিবার নিয়ে  ঘুরতে যেতে পারেন,  অথবা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে যেতে পারেন আড্ডা দিতে । বাচ্চারা জায়গাটা খুব পছন্দ করে তাঁরা দৌড়ায়,  খেলে ,  আনন্দ করে , অনেক কিছু দেখে এবং শেখে । শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য এই জায়গাটা একটি আদর্শ ভ্রমণ স্থান হতে পারে । যারা শহরে বড় হয়েছে এবং গ্রাম দেখেনি তাদের জন্য জিন্দা পার্ক অত্যন্ত একটি উপভোগ্য জায়গা হতে পারে । আমার মতে জিন্দা গ্রাম তো ঢাকার বুকে ছোট্ট একটি বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি । এখানকার প্রাকৃতিক গ্রামীণ পরিবেশ যেকোনো বয়সের মানুষের জন্যই একটি সুখকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হতে পারে  । 

 

জিন্দা-পার্ক-এর-বাশের-সাকো
জিন্দা পার্ক এর বাশের সাকো

 

এখানে ঘুরতে কেমন খরচ হতে পারে 

খরচ বলতে গেলে,  জিন্দা পার্কের প্রবেশ টিকিটের মূল্য ১০০ টাকা । আর যদি আপনি নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসেন তাহলে পার্কিং বাবদ আপনাকে গুনতে হবে ৫০ টাকা । যদি বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসেন তাহলে খাবার ভেতরে নেওয়ার জন্য আপনাকে দিতে হবে বাড়তি ১০০ টাকা ।  আর যদি লাইব্রেরীতে যেতে চান তাহলে লাইব্রেরীর জন্য আলাদা টিকিট নিতে হবে ৫0 টাকার যা লাইব্রেরির ভেতর থেকে কাটতে পারবেন। এছাড়া আপনি যদি পুকুরে নৌকায় ঘুরতে চান তাহলে আধা ঘন্টার জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে ২০০ টাকা । ভিতরে রেস্টুরেন্ট আছে রেস্টুরেন্ট থেকে আপনি বিভিন্ন দামে বিভিন্ন খাবার খেতে পারবেন,  স্বল্প খরচে দুপুরের খাবারের সুব্যবস্থা রয়েছে,  এছাড়াও অন্যান্য খাবার এখানে রয়েছে । 

 

ঘুরতে যাওয়ার আগে যা জানা দরকার 

জিন্দা পার্ক বছরে ৩৬৫ দিনই খোলা থাকে,  নির্দিষ্ট বন্ধের কোন দিন নায় ।  প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পার্ক টি খোলা থাকে তার মানে সকাল থেকে সন্ধ্যা ।  এখানে রাতে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই । আপনি যদি পিকনিক করতে চান বা পিকনিকের জন্য বুকিং করতে চান তাহলে আপনাকে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হবে।      ০১৭১৬২৬০৯০৮,  ০১৭১৫০২৫০৮৩, ০১৭২১২৬৬৬১০ এই নাম্বার গুলোতে কল দিয়ে আপনি যোগাযোগ করতে পারেন অথবা তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন ।  

 

পার্ক টি  কি ঘুরতে যাওয়ার জন্য নিরাপদ 

আমার কাছে যা মনে হয়েছে পার্ক টি খুবই নিরাপদ এবং এখানে কেউ আপনার আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, এমনকি আপনাকে কোন কিছুর জন্য বিরক্ত করবে না, আপনি প্রেমিকা নিয়ে আসলেও কারো মাথা ব্যাথা নেই ।  আপনার কাছে কোনো ভিক্ষুক পয়সা চাবেনা অথবা আপনাকে কোন হিজলা বিরক্ত করবে না,  এরকম কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না । 

 

এখানে যাওয়ার ব্যবস্থা কি 

আমার মত এখানে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত যানবাহনে সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে, কারণ এখানে যাওয়ার জন্য সরাসরি কোনো পাবলিক সার্ভিস নেই । সেজন্য আপনার যদি প্রাইভেট কার থাকে অথবা মোটরসাইকেল থাকে তাহলে আপনি সেই মাধ্যমে এখানে আসলেই সবচেয়ে ভালো হবে ।  এছাড়া অন্য ভাবে আসলে প্রথমে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত আসবেন  । কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে 300 ফিট এর রাস্তা ধরে কাঞ্চন ব্রিজের দিকে যেতে হবে । এখানে বিআরটিসি বাস পেয়ে যাবেন কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ যার জন্য,  ভাড়া পরবে পঁচিশ টাকা । কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত যাওয়া লাগবেনা কাঞ্চন ব্রিজ এর আগেই নেমে পড়তে হবে ঠিক ঢাকা সিটি বাইপাস এর মোড়ে । এই মোড় থেকে আপনাকে অটোরিকশা করে জিন্দা গ্রামে পৌঁছতে হবে , অটোরিকশা ভাড়া চাবে ৩০/৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ।

 

জিন্দা-পার্ক-এর-ড্রাম-ব্রীজ
জিন্দা পার্ক এর ড্রাম ব্রীজ

 

আমার অভিজ্ঞতা 

আমি এখন পর্যন্ত জিন্দা পার্কে মোট তিন বার গিয়েছি । প্রথমবার তো এখানে এসে অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম যে এত সুন্দর একটি গ্রাম এখানে ঢাকার এত কাছে রয়েছে, আসলেই দারুন । দ্বিতীয়বার এসেছিলাম ফটোগ্রাফি করার জন্য কারণ জায়গাটা ছবি তোলার জন্য অস্থির একটা জায়গা । অনেকেই দেখলাম প্রি ওয়েডিং ফটোশুট করছে এখানে । ফটোগ্রাফারদের জন্য এখানে অনেক দারুন দারুন সাবজেক্ট রয়েছে, যেমন গাছ , পুকুর , বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ,  গ্রামীণ পরিবেশ , গ্রামীণ ঘর , এমন কি আপনি এখানে তাল গাছ এবং পাকা পাকা তাল গাছের নিচে পড়ে থাকতে দেখবেন, খুবই চমৎকার । তৃতীয়বার অবশ্য  গিয়েছিলাম যখন শাপলা বিল রিসোর্ট ঘুরতে এসেছিলাম । জিন্দা পার্ক এর পাশেই শাপলা বিল রিসোর্ট, এখানে ঘুরতে আসলে একই সাথে দুইটা জায়গায় ঘুরতে পারবেন । শাপলা বিল যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে ভোরবেলা ,  মানে সকাল দশটা পর্যন্ত আপনি শাপলা ফুল ফুটে থাকতে দেখতে পারবেন । আপনি দশটা পর্যন্ত শাপলা বিলে থাকার পর সেখান থেকে খুব সহজেই জিন্দা পার্কে এসে বাকিটা সময় জিন্দা পার্কে কাটাতে পারেন ।  তবে জিন্দা পার্কের পুকুরেও আপনি কিছু শাপলা ফুল দেখতে পাবেন । এছাড়া জিন্দা পার্কের প্রবেশ পথে গেটের সামনে আপনি ছোট ছোট একুরিয়ামের মত জলাধার দেখতে পাবেন যেখানে প্রচুর মাছ রয়েছে, জিনিসটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিল । জিন্দা পার্কের ভিতর একটি স্কুল আছে । স্কুল টি খুবি চমৎকার এবং স্কুলের সামনে বিশাল খেলার মাঠ রয়েছে । সুন্দর একটি মসজিদ রয়েছে এখানে,  মসজিদের পাশে ওযু করার সু ব্যবস্থাও রয়েছে। আর দুপুরের খাবার সাথে না নিয়ে আসলে খাবার খাওয়ার জন্য তো ক্যান্টিন পেয়েই যাচ্ছেন ।  

জিন্দা-পার্ক-এর-পুকুর
জিন্দা পার্ক এর পুকুর
জিন্দা-পার্ক-এর-মসজিদ
জিন্দা পার্ক এর মসজিদ
জিন্দা-পার্ক-এর-লাইব্রেরী
জিন্দা পার্ক এর লাইব্রেরী

 তো এই ছিল আমার জিন্দা পার্কের গল্প ।  এবারের গল্প এখানেই শেষ করা যাক, অন্যান্য গল্প গুলো পড়ার অনুরোধ জানিয়ে সমাপ্ত করলাম,  আর হ্যাঁ গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 

Write A Comment